বোরো ধানের তুলনায় আমন ধান চাষে তুলনা মূলক ভাবে কম পরিশ্রম হয়। একটু কৌশল অবলম্বন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। আর এর জন্য ধানের ভালো জাত, সার ও পরিচর্যার কৌশল সম্পর্কে জানা থাকলে কৃষক অনেক লাভজনক হতে পারে।
আমন ধানের ভালো ফলন পেতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ও কৃষিবিদরা বলেন, আমন ধান চাষে সফল হতে চাইলে শুরুতেই ধানের ভালো জাত নির্বাচন করা খুবই জরুরি। ধানের বিভিন্ন জাত আছে, কৃষককে সঠিক জাতটি বেছে নিতে হবে। আমন ধানের অধিক ফলন পেতে ধাপে ধাপে যত্ন নিতে হবে।
আমন ধান
আমন ধানের পরিচর্যা সংক্রান্ত কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, শ্রাবণ মাস আমন ধান রোপণের সর্বোচ্চ মৌসুম। চারা ৩০ থেকে ৪০ দিন বয়স হলে মাটিতে রোপণ করতে হবে।
আমন শব্দটি আরবি শব্দ ‘আমান’ থেকে এসেছে যার অর্থ আমানত। অর্থাৎ আমন কৃষকের কাছে নিশ্চিত ফসল (শিওর ক্রপ) বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। অনাদিকাল থেকে এই ধান চাষে কৃষকের পেট ভরে, যা দিয়ে কৃষক তার পরিবারের ভরণপোষণ, পিঠাপুলি, আতিথেয়তাসহ পরিবারের অন্যান্য খরচ মেটায়। গত ২০১৬/১৭ আমন মৌসুমে, দেশে প্রায় 5.5-5.6 মিলিয়ন হেক্টর আমন ধান চাষ করা হয়েছিল, যার মধ্যে 0.328 মিলিয়ন হেক্টর বোনা, 1.083 মিলিয়ন হেক্টর। স্থানীয় জাতের এবং 4.172 মিলিয়ন হেক্টর উফশী রোপা আমনের চাষ হয়।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে ২০১৭/১৮ মৌসুমে আমানাবাদ এলাকা 2% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ০.৩৬৫ মিলিয়ন হেক্টর বোনা, ০.৯৪৫ মিলিয়ন হেক্টর। স্থানীয় জাতের এবং ৪.৩৯৫ মিলিয়ন হেক্টর উফশী চারা আমন চাষ হয়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতিবছর আমন উৎপাদন বাড়ছে এবং গত বছর আমন উৎপাদন ১ কোটি ৪০ লাখ টনে পৌঁছেছে। এর পেছনে নতুন উদ্ভাবিত জাত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারের সঠিক নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আমন ধান প্রধানত দুই প্রকার; রোপা আমন ও বোনা আমন। এর এমন নামকরণ করা হয়েছে কারণ রোপা আমন অন্য জমিতে চারা তৈরি করে, তারপর সেই চারা জমিতে রোপণ করে এবং ধান উৎপাদন করে। রোপা আমন আষাঢ় মাসে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ (এলকাবেদে) মাসে ধান কাটা হয়।
বোনা আমন ছিটিয়ে বোনা হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে জমিতে আমন বীজ বপন করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়। একে আচার আমন, বাওয়া আমন বা গভীর পানির আমনও বলা হয়। আমন মৌসুমে চাষকৃত এলাকা সম্প্রসারণের খুব বেশি সুযোগ না থাকায় ফলন বাড়াতে নতুন জাতের চাষের সঙ্গে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি।
ভালো বীজ নির্বাচন, জমি তৈরি, সঠিক সময়ে বপন বা রোপণ, আগাছা নিয়ন্ত্রণ, সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা এবং সম্পূরক সেচের মতো বিষয়গুলো আমন ধানের ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুরুতে আমন ধানের জান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
আমন ধানের জাত নির্বাচন
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উফশী ধানের ৩৯টি ইনব্রিড এবং ২টি হাইব্রিড মোট ৪১টি জাত আমন মৌসুম ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো হয়েছে এবং বিভিন্ন রকম কৃষি ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করা হয়েছে। অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশে আমন চাষ করা যায় এমন জাতসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো।
আমন ধানের অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতসমূহ :
বিআর৪,
বিআর৫,
বিআর১০,
বিআর১১,
ব্রি ধান৩০,
ব্রি ধান৩২,
ব্রি ধান৩৩,
ব্রি ধান৩৪,
ব্রি ধান৩৯,
ব্রি ধান৪৯,
ব্রি ধান৬২,
ব্রি ধান৭৯,
ব্রি ধান৭১,
ব্রি ধান৭২,
ব্রি ধান৭৫,
ব্রি ধান৮০,
ব্রি ধান৮৭।
প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য জাত
খরাপ্রবণ এলাকায় জন্য উপযোগী আমন ধানের জাত
ব্রি ধান৫৬,
ব্রি ধান৫৭
ব্রি ধান৬৬,
ব্রি ধান৭১
বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য উপযোগী আমন ধানের জাত
ব্রি ধান৫১,
ব্রি ধান৫২,
ব্রি ধান৭৯।
এছাড়া
বিআর২২,
বিআর২৩,
ব্রি ধান৪৬
এই জাত গুলোর নাবি গুণ থাকার জন্য এদের বীজ ২০-৩০ শ্রাবণে বপন করে ৩০-৪০ দিনের চারা সর্বশেষ ৩১ ভাদ্র পর্যন্ত বন্যা প্রবণ এলাকায় রোপণ করা যায়।
লবণাক্ত এলাকায় আমন ধানের জাত
বিআর২৩,
ব্রি ধান৪০,
ব্রি ধান৪১,
ব্রি ধান৫৩,
ব্রি ধান৫৪,
ব্রি ধান৭৩,
ব্রি ধান৭৮।
জোয়ার-ভাটা প্রবণ অলবণাক্ত এলাকার উপযোগী আমন ধানের জাত
ব্রি ধান৪৪,
ব্রি ধান৫২,
ব্রি ধান৭৬,
ব্রি ধান৭৭
জলাবদ্ধ এলাকার জন্য উপযোগী আমন ধানের জাত
বিআর১০,
বিআর২৩,
ব্রি ধান৩০,
ব্রি ধান৭৯,
ব্রি ধান৭৬,
ব্রি ধান৭৮
বরেন্দ্র এলাকার জন্য আমন ধানের জাত
ব্রি ধান৫৬,
ব্রি ধান৫৭,
ব্রি ধান৬৬,
ব্রি ধান৭১,
ব্রি ধান৭৫,
ব্রি ধান৮০।
এছাড়া সুগন্ধি
ব্রি ধান৩৪ সহ সমতল বরেন্দ্র অঞ্চলে অনুকূল পরিবেশের জন্য সুপারিশকৃত সব জাতই চাষ করা সম্ভব।
পাহাড়ি এলাকার জন্য উপযোগী আমন ধানের জাত
পাহাড়ি এলাকার জন্য উপযোগী জাত গুলোর মধ্যে রয়েছে
ব্রি ধান৪৯,
ব্রি ধান৭০,
ব্রি ধান৭১,
ব্রি ধান৭৫,
ব্রি ধান৮০।
প্রিমিয়াম কোয়ালিটি আমন ধানের জাত
দিনাজপুর, নওগাঁসহ যেসব এলাকায় সরু বা সুগন্ধি ধানের চাষ হয় সেখানে
বিআর৫,
ব্রি ধান৩৪,
ব্রি ধান৩৭,
ব্রি ধান৩৮,
ব্রি ধান৭০,
ব্রি ধান৭৫
ব্রি ধান৮০ চাষ করা যায়।
ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাত
আমন মৌসুমের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতগুলো হলো ব্রি হাইব্রিড ধান৪ ও ৬। এ জাতগুলো বন্যামুক্ত এলাকায় রোপা আমনে অনুকূল পরিবেশে চাষযোগ্য। এ জাতগুলোর চাল মাঝারি চিকন, স্বচ্ছ ও সাদা এবং লম্বা, ভাত ঝরঝরে হওয়ায় কৃষকের কাছে পছন্দনীয়।
নতুন উদ্ভাবিত আমনের জাত
ব্রি ধান৭১,
ব্রি ধান৭২,
ব্রি ধান৭৫,
ব্রি ধান৭৯,
ব্রি ধান৮০
ব্রি ধান৮৭ জাতগুলো চাষ করে প্রতিনিয়ত উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
আমন ধানের চারা রোপণ পদ্ধতি
রোপণ লাইন বা সারি করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য উত্তর-দক্ষিণ রেখা বরাবর রোপণ করা ভালো। সাধারণত সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি। (8 ইঞ্চি) এবং ক্লাস্টার থেকে ক্লাস্টারের দূরত্ব ১৫ সেমি (৬ ইঞ্চি) হলে ভালো ফলন দেবে। তবে জমি উর্বর হলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেমি (১০ ইঞ্চি) হতে হবে এবং ক্লাস্টার থেকে ক্লাস্টার দূরত্ব ১৫ সেমি (৬ ইঞ্চি) স্থাপন করা যেতে পারে।
আমন ধানে সুষম সার ব্যবস্থাপনা
আমন মৌসুমে ধানের ফলন বাড়াতে সুষম সার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা জরুরি। আজকের নিবন্ধে আমন ধানের সুষম সার ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আমাদের আরও পোষ্ট-
বীজতলায় সার ব্যবস্থাপনা
বীজতলা তৈরি এবং বীজ বপনের সময়:
উঁচু ও উর্বর জমিতে যেখানে বন্যার পানি উঠার সম্ভাবনা নেই সেখানে বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেখানে ভাসমান বীজতলার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘ, মাঝারি ও স্বল্প মেয়াদী জাত বিভিন্ন স্থানে ও সময়ে বপন করতে হবে।
মাঝারি ও পরিমিত উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোনো সারের প্রয়োজন হয় না। তবে নিচু, খুব নিচু বা অনুর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর বা জৈব্য সার প্রতি শতকে ২ মণ হারে প্রয়োগ করতে হবে। বীজতলায় চারা হলুদ হয়ে গেলে চারা গজানোর ২ সপ্তাহ পর প্রতি শতকে 250 গ্রাম ইউরিয়া সার মাটিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরও চারা হলুদ হয়ে গেলে প্রতি শতকে ৪০০ গ্রাম জিপসাম সার মাটিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
ভালো চারার জন্য ভালো বীজের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিএডিসি, স্থানীয় কৃষি বিভাগ বা বিআর অফিসের সাথে যোগাযোগ করে ভালো বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে।
আমন ধান চাষের মূল জমিতে সার প্রয়োগের হার ও প্রয়োগ পদ্ধতি
আমন ধানের অধিক ফলন পেতে শুধু ইউরিয়া নয়, সঠিক সময়ে এবং সুষম পরিমাণে বিভিন্ন জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা অপরিহার্য। রাসায়নিক সারের মধ্যে রয়েছে ডায়ামোনিয়াম ফসফেট, ট্রিপল সুপার ফসফেট, মিউরেট অফ পটাশ, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (ম্যাগসার, অ্যাগ্রোমাগভিট), জিঙ্ক সালফেট (মনো বা হেপ্টা) বা চেলেটেড জিঙ্ক (লিবারেল জিঙ্ক), বোরিক অ্যাসিড, দ্রবণীয় বোরন (লিবারেল বোরন) ইত্যাদি।
সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে সার ব্যবহার করতে হবে। তবে বেশির ভাগ কৃষকই মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারে ঝুঁকছেন। কিন্তু এটা জানা জরুরী যে, অতিরিক্ত ইউরিয়া প্রয়োগের ফলে ওই জমিতে ফসফরাস ও পটাশ সারের পরিমাণ মারাত্মক হারে কমে যায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ফলন পেতে বিঘা প্রতি (৩৩ শতক) ২১ কেজি ইউরিয়া, ৭ থেকে ১০ কেজি টিএসপি/ডিএপি, ৩.৫ থেকে ১৩.৫ কেজি মিউরেট অফ পটাশ, ৪ থেকে ১১ কেজি জিপসাম। উফশী জাতের ধান। ২ কেজি জিঙ্ক সালফেট এবং ৩৫ মণ গোবর বা জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
রাসায়নিক সার সাশ্রয়ে কয়েকটি নতুন প্রযুক্তি
কিছু নতুন প্রযুক্তি যা রাসায়নিক সার সংরক্ষণ করে তা হল গাছের নাইট্রোজেন পুষ্টির ঘাটতি পূরণের জন্য মাটিতে ইউরিয়া প্রয়োগ। ইউরিয়া বাঁচাতে সূক্ষ্ম ইউরিয়া প্রযুক্তির ব্যবহার, পাতার রঙের চার্ট অনুযায়ী ইউরিয়া প্রয়োগ, বিভিন্ন ধরনের জৈবসার (সবুজ সার, আবর্জনা পচা সার, পচা গোবর), নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়াল ইনোকুলামসহ আমন ধান চাষের জমিতে অ্যাজোলা চাষ করা যেতে পারে।
গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০% কম ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন পরে। আর গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ফলও ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। সবুজ সার হিসেবে ধইঞ্চার চাষ, গ্রীষ্মকালীন মুগ/মাষকলাই চাষ করার মাধ্যমে ইউরিয়ার ব্যবহার অনেকাংশে কমানো যায়।
অন্যদিকে ডায়ামোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি ব্যবহার করে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফরাসের ঘাটতি মেটানো সম্ভব। জিংক সালফেট (মনো বা হেপ্টা) সার ফসফরাস সারের সাথে একত্রে ব্যবহার করা যাবে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য জিঙ্ক ও বোরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে চিলেটেড জিঙ্ক যেমন লিবারেল জিঙ্ক এবং দ্রবণীয় বোরন যেমন লিবারেল বোরন।
মূল জমিতে ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর ১ম বার এবং ৪০-৪৫ দিন পর ২য় বার ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবারেল জিংক ও ২ গ্রাম লিবারেল বোরন একত্রে মিশিয়ে দিলে উপকার পাওয়া যাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈব সার ব্যবহার করা হলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব। এছাড়াও, জৈব সার রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে, মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি করে এবং নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম এবং অন্যান্য গৌণ ও গৌণ পুষ্টি সরবরাহ করে।
আরও পড়ুনঃ
আমন ধান চাষে সম্পূরক সেচ
আমন চাষ সম্পূর্ণভাবে বৃষ্টি নির্ভর। কিন্তু প্রতি বছর বৃষ্টিপাত সব জায়গায় সমান হয় না। এমনকি একই বছরে একই জায়গায় সবসময় সমান বৃষ্টিপাত হয় না। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০% আমন মৌসুমে হয়, যা আমন চাষের জন্য যথেষ্ট। তবে সময়মতো বর্ষা না হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টির অভাবে সাময়িক খরার যে কোন পর্যায়ে বৃষ্টিনির্ভর ধানক্ষেতে সম্পূরক সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূরক সেচের সংখ্যা একাধিক হতে পারে। অন্যথায় ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে দেকি নজর দেখান একান্ত জরুরী।
আমন ধান চাষে আগাছা ব্যবস্থাপনা
মনে রাখবেন ধান ক্ষেতকে ৩৫-৪০ দিন আগাছামুক্ত রাখলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। আগাছা কয়েকটি উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যেমন, আগাছা হাত দিয়ে, আগাছা নিড়ানোর যন্ত্র দিয়ে এবং আগাছানাশক ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে হাতে নিড়ানি রদওয়া সব থেকে ভালো উপায়। আমন ধান অন্তত দুইবার হাতে নিড়ানি দিতে হবে।
প্রথমবার ধান রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। ধানের দুই সারির মাঝখানের আগাছা নিড়ানী মেশিন দিয়ে দমন করা হলেও দুই গুচ্ছের মাঝখানে থাকা আগাছা হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। যান্ত্রিক দমনে ধান রোপণ করতে হবে। আগাছানাশক ব্যবহারের মাধ্যমে কম পরিশ্রমে এবং কম খরচে প্রচুর পরিমাণে জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রাক-আগাছানাশক ধান রোপণের ৩-৬ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে (আগাছা বের হওয়ার আগে) এবং উত্থান-পরবর্তী হার্বিসাইড ধান রোপণের ৭-২০ দিনের মধ্যে (আগাছা বের হওয়ার পর) প্রয়োগ করতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় মাটিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকা ভালো। বর্ষা মৌসুমে ভেষজনাশক প্রয়োগের পর সাধারণত হাত আগাছার প্রয়োজন হয় না। তবে আগাছার ঘনত্ব বেশি হলে আগাছানাশক প্রয়োগের ৩০-৪৫ দিন পর হাত আগাছার প্রয়োজন হয়।
আমন ধান চাষে কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদ এবং আবহাওয়া জানত কারনে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বাড়াতে পারে। ফলে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। আমনের প্রধান কীটপতঙ্গ হল: মাজরা পোকা, পাতার মোড়া পোকা, চুঙ্গি পোকা, সবুজ পাতার পোকা, বাদামী ট্রিহপার, সাদা ব্যাকড ট্রিহপার, গান্ধী পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। পোকার ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে পোকার প্রজাতির উপর। পোকামাকড়, এলাকার সার্বিক পরিবেশ, জমি বা তার আশেপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধান গাছের বয়স, উপকারী ও পরজীবী পোকার সংখ্যা ইত্যাদি।
ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা পাওয়া গেলে, বন্ধুত্বপূর্ণ পোকামাকড়ের সংখ্যা যেমন মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল এবং অনেক পরজীবী এবং পরজীবী কীটপতঙ্গ পরীক্ষা করা উচিত এবং প্রয়োজন হলেই কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত। বড় পোকার উপদ্রব দমন করলে রোপণের মৌসুমে ফলন ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ধান ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে রাখলে তা অনেকাংশে লেফফপার ও লিফফপারের আক্রমণ কমাতে পারে।
আলোক ফাঁদ/সৌর আলোক ফাঁদ শুঁয়োপোকা এবং পাতাফড়িং, সবুজ পাতা ও শুঁয়োপোকার আক্রমণ কমাতে পারে। মাটি থেকে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে পুঁচকে, বাদামী প্ল্যান্টথপার এবং সাদা পিঠের প্ল্যান্টথপারের উপদ্রব কমানো যায়। উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও যদি পোকামাকড়ের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয় তবে মাজরা পোকা, পাতার মোড়ক এবং চুঙ্গি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিঘা প্রতি ১৮০- হতে ১৯০ গ্রাম হারে Suntap 50 পাউডার ব্যবহার করতে হবে। ম্যাগটস এবং লিফফপার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি বিঘা ১০ গ্রাম হারে Virtaco 40 WG ব্যবহার করতে হবে। মিপসিন ৭৫ পাউডার ১৭৫ গ্রাম প্রতি বিঘা, Pymetrogen 40 WG 67 গ্রাম, Darsban 20 EC 134 মিলি হারে বাদামী প্ল্যান্টথপার এবং সাদা পিথ প্ল্যান্টথপার নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করতে হবে। কারবারিল 85 পাউডার বা সেভিন পাউডার প্রতি বিঘা 228 গ্রাম হারে ব্যবহার করতে হবে পাতাফড়িং, পাতাফড়িং এবং পাতাফড়িং নিয়ন্ত্রণ করতে।
আমন ধান চাষে রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন মৌসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত খোল পচা, টুংরো, পাতা পোড়া, খোলপোড়া, ব্লাস্ট, বাদামি দাগ, বাকানি এবং লক্ষ্মীরগু (ঋধষংব ঝসধৎঃ) সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোগ হল স্ক্যাব, ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট, ব্লাস্ট, টুংরো, বকানি ও লক্ষশিরগু রোগ। স্ক্যাব রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য পটাশ সার সমান দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ জমিতে শেষ চাষে প্রয়োগ করতে হবে এবং অন্য অংশ ইউরিয়া সারের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ভেজা ও শুষ্ক পদ্ধতিতে পর্যায়ক্রমে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ফলিকুর, নাটিভো এবং স্কোরের মতো ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতার ব্লাইটের প্রাথমিক পর্যায়ে ৫ শতাংশ মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। থ্রেসার বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে প্রতি বিঘায় ৫ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।
এ মৌসুমে সব সুগন্ধি ধানেই নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে ট্রপার বা নাটিভোর মতো প্রতিরোধক ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্যানিকেলের শেষ পর্যায়ে বা দানার মাথা বের হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োগ করতে হবে। টুংরো রোগের লক্ষণ এক বা দুটি গাছে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ তুলে পুঁতে ফেলতে হবে। যদি রোগের বাহক গ্রিন লিফফপার উপস্থিত থাকে তবে হ্যান্ড জাল দিয়ে বা আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ শাক মেরে ফেলুন।
যদি একটি সবুজ শাক-পাতা হাতের জালে আকৃষ্ট হয়, তাহলে একটি কীটনাশক, যেমন মিপসিন, সেভিন বা ম্যালাথিয়ন, বীজতলায় বা জমিতে অনুমোদিত হারে প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ্শিরগু (বিশেষ করে ব্রি ধান৪৯ জাতের) নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন টিল্ট (১৩২ গ্রাম/বিঘা) ফুল ফোটার সময় বিকেলে সাত দিনের ব্যবধানে দুবার প্রয়োগ করতে হবে।
আমন ধান কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
ধান পাকলে ফসল কাটা উচিত। অত্যধিক পাকা পর্যায়ে ধান কাটার ফলে প্রচুর ধান ঝরে যেতে পারে, কান ভেঙ্গে যেতে পারে এবং কানের কীট ও পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসলের পরিপক্কতা পরীক্ষা করুন। ৮০% শস্যের ডগা শক্ত হলে ধান পাকা বলে মনে করা হয়। এ সময় ক্ষেত বা উঠানে ফসল কেটে মাড়াই করতে হবে।
নতুন উন্নত মাড়াই মেশিন যেমন রিপার, হেড ফিড কম্বাইন হারভেস্টার এবং মিনি কম্বাইন হারভেস্টার দ্রুত মাড়াইয়ের জন্য ব্যবহার করা উচিত। ধান মাড়াইয়ের জন্য পরিষ্কার জায়গা বেছে নিতে হবে। ধানক্ষেতে সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রং উজ্জ্বল ও পরিষ্কার হয়। মাড়াইয়ের পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকাতে হবে। ভালো করে শুকানোর পর নেড়ে সংরক্ষণ করুন।
আমন ধানের বীজ উৎপাদন
উপরোক্ত নিয়মে সুষম সার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সম্পূরক সেচ ও সময়মতো কীটনাশক প্রয়োগ করলে আমনের বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব। ধানের আগাছা নিয়ে কৃষকরা সব সময় চিন্তিত থাকেন। আমন ধানের আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য মূল জমিতে চারা রোপণের ৫-৭ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সম্মিলিত আগাছানাশক প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) ১০০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে ধানের বীজ উৎপাদনে ১৫ শতাংশ কম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
ধান পাকার ঠিক আগে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪০-৪৫ গ্রাম এগ্রিসাল/থায়োভিট/মাইকোসাল (৮০ শতাংশ সালফার) স্প্রে করলে বীজের রং উজ্জ্বল হবে এবং ধানে কালো বা বাদামী দাগ রোধ হবে। ধান কাটার পর তা সঠিকভাবে মাড়াই করে কড়া রোদে শুকাতে হবে। তারপর ব্যাগে করে গুদামে রাখতে হবে। সঞ্চয়স্থানে প্রতি টনে ৪ পিচ হারে ফস্টক্সিন গ্যাস ট্যাবলেট প্রয়োগ করলে ধান সংরক্ষণকারী বোরারের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। তবে মনে রাখবেন হাইব্রিড ধানের বীজ পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ হিসেবে রাখা যাবে না।